নবীন হাসান : উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে শীতের আগমনের সঙ্গে শুরু হয়েছে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির ধুম। এই গুড় স্থানীয় হাট-বাজার থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মিষ্টি পণ্য তৈরির জন্য ব্যাপক চাহিদা পূরণ করে। পিঠা-পুলি, পায়েসসহ শীতকালীন নানা খাবারের উপকরণ হিসেবে খেজুরের গুড়ের কদর সর্বত্র।
সকালের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গাছিরা ছুটে যান মাঠে। সারি সারি খেজুর গাছে আগের রাতেই ঝুলিয়ে রাখা হয় মাটির হাঁড়ি। সারা রাত ধরে গাছ থেকে ঝরে পড়া রস এই হাঁড়িতে জমা হয়। ভোরবেলা রস সংগ্রহ শেষে শুরু হয় গুড় তৈরির কাজ।
গাছিরা প্রথমে সংগ্রহ করা রস বড় বড় হাঁড়িতে জড়ো করেন। এরপর এই রস ছেঁকে নিয়ে চুলায় বসানো হয় বড় টিনের পাত্রে। ঘণ্টাখানেক ধরে জ্বাল দেওয়ার পর রস ঘন হয়ে শুরু করে গুড়ের রূপ নেওয়া। পরে গরম ঘন রস ঢালা হয় ছোট ছোট খাঁচায়। ঠান্ডা হলে তা শক্ত হয়ে সুস্বাদু খেজুরের গুড়ে পরিণত হয়।
স্থানীয় দর্শনার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রথমবার খেজুরের গুড় তৈরির প্রক্রিয়া দেখতে এসেছি। এখানকার গুড়ের স্বাদ অসাধারণ। পরিবার নিয়ে গুড় কিনতে এসেছি।”
আরেক দর্শনার্থী রাবেয়া খাতুন বলেন, “এখানে সরাসরি গুড় তৈরি হতে দেখে কিনতে আলাদা আনন্দ লাগে। পরিবারের জন্য ৫ কেজি গুড় নিয়ে যাচ্ছি।”
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নারগুণ ইউনিয়নের বোচাপুকুর গ্রামে রাজশাহী জেলার কয়েকজন গাছি চুক্তিতে খেজুর গাছ ভাড়া নিয়ে কাজ করছেন। তারা জানালেন, এ বছর গাছের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া দিতে হয়েছে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
গাছি আব্দুল খালেক বলেন, “আমরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গুড় তৈরি করছি। প্রতিদিন প্রায় ১২০ কেজি গুড় উৎপাদন করছি। তবে গাছের লিজের দাম এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এবার প্রতি কেজি গুড়ের দাম ৫০ টাকা বাড়াতে হয়েছে। পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা, আর খুচরা ৩০০ টাকা দরে।”
আরেক গাছি আমিনুল ইসলাম জানান, “গাছ ভাড়া বেশি হওয়ায় লাভ একটু কম হচ্ছে। তবে শীতের সময়ে রস আর গুড়ের চাহিদা ভালো থাকায় আয় কিছুটা বেড়েছে।”
ঠাকুরগাঁও জেলা সিভিল সার্জন ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ জানান, কাঁচা খেজুরের রস পান করা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, “কাঁচা রস থেকে নিপাহ ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। তাই আমরা গাছিদের স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ এবং গাছে নেট ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছি। নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে।”
খেজুরের গুড় উৎপাদন স্থানীয় অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। গাছিদের মতে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঠাকুরগাঁওয়ের স্বাস্থ্যসম্মত গুড় উৎপাদন দেশের চাহিদা মেটাতে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, “শীত মৌসুমে খেজুরের গুড় আমাদের অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে। তবে আধুনিক পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলে গাছিরা আরও বেশি লাভবান হবে।”
ঠাকুরগাঁওয়ের শীতকালে খেজুরের গুড় শুধু একটি খাদ্য উপকরণ নয়, এটি এই অঞ্চলের সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাকৃতিকভাবে প্রস্তুত এই গুড় দেশব্যাপী মিষ্টিপ্রেমীদের মন জয় করে চলছে। সরকারি উদ্যোগ থাকলে এ শিল্পটি আরও উন্নতি করতে পারে।