Home » গম চাষে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকরা, অনেকে কেটে খাওয়াচ্ছেন গরুকে

গম চাষে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকরা, অনেকে কেটে খাওয়াচ্ছেন গরুকে

by নিউজ ডেস্ক
নবীন হাসান/জাহিদ হাসান মিলু: এক সময় যে জেলা গম উৎপাদনে বিখ্যাত ছিল সেই জেলার কৃষকরা দিন দিন গম চাষে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। মাত্র ৮ বছরের ব্যবধানে ঠাকুরগাঁওয়ে গমের আবাদ কমেছে ৩৬ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমি। ২০১৭ সালে জেলায় ৬৭ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে গমের আবাদ হলেও ২০২৪ সালের চলতি মৌসুমে চাষ হয়েছে মাত্র ৩১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে। তার পরেও আবার অনেক গম চাষি গম কেটে ঘাস হিসেবে বিক্রয় করছেন। কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, যারা ঘাস হিসেবে গম কেটে গবাদি পশুকে খাওয়াচ্ছেন বা বিক্রয় করছেন সে গুলো আবাদের লক্ষমাত্রায় ধরা হয়নি। এদিকে গমের চাষ বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে বলছেন তারা।
বিগত কয়েক বছর আগে এই সময়ে গম আবাদের মৌসুমে জেলার দিগন্ত জোড়া মাঠ-ঘাটে তাকালেই চোখে পড়ত সবুজে ঘেরা গমের ফসল। বর্তমানে ফসলের মাঠ-ঘাট গুলোতে খুঁজে বেড় করতে হচ্ছে গমের ফসল।
জেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা যায়, আগে যে জমিতে চাষ করা হতো গম। এখন সেগুলোতে গম বাদে চাষ করা হচ্ছে অন্যান্য বিভিন্ন ফসল। জেলায় গমের আবাদ অর্ধেকে নেমে এসেছে। এমন অবস্থায় গম চাষিরা আবার চাষকৃত গম ক্ষেত কেটে ঘাস হিসেবে বিক্রয় করছেন। খাওয়াচ্ছেন গবাদি পশুকে।

এজেলার মাটি বেশ ভালো উর্বর হওয়ায় গমের আবাদ ভালো হয়। তবে বর্তমানে গমের তুলনায় অন্যান্য ফসলের ফলন এবং দাম বেশি পাচ্ছেন কৃষকরা। ফলে দিন দিন গম চাষ কমিয়ে দিচ্ছেন তারা। ঝুঁকে পড়ছেন অন্যান্য ফসল চাষে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালে জেলায় গমের আবাদ হয়েছিল ৬৭ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে। ৪ বছরের মাথায় ২০২০ সালে আবাদ কমে দাঁড়ায় ৫০ হাজার ৬৫০ হেক্টরে। ওই বছর উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮৫ মেট্রিক টন ও ২০২২ সালে চাষ হয়েছিল ৪৫ হাজার ১৯২ হেক্টর জমিতে আর উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৯৪ হাজার ৭১ মেট্রিক টন। ২০২৩ সালে তার থেকেও আবাদ কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৬ হাজার ৬৫৭ হেক্টরে আর উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৭৯ মেট্রিক টন গম। আর ২০২৪ সালের চলতি মৌসুমে আবাদের লক্ষমাত্রা ৩৬ হাজার ৬৫৭ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে মাত্র ৩১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে।

কৃষকরা বলছেন, গমের তুলনায় ভূট্টা ও আলুতে ভালো ফলন এবং দাম বেশি পাওয়া যায়। তাই তারা গমের থেকে লাভজনক ফসলের আবাদ করছেন। এছাড়াও যেসব গম বেশি ঘন হয়ে গেছে সেসব গম কেটে বিক্রয় ও গরুকে খাওয়াচ্ছেন। তাতে ৫০ শতকের একবিঘা জমির গম ঘাস হিসেবে কেটে বিক্রয় করলে তারা ৬০-৭০ হাজার টাকা পাচ্ছেন। এর পর আবার ওই জমিতে তারা ভূট্টা বা বোরো ধান রোপন করতে পারচ্ছেন। এভাবে তারা বেশি লাভবান হচ্ছেন।

সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর এলাকার কৃষক লোকমান আলী বলেন, এক সময় আমাদের ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যাপক গম আবাদ হতো। কিন্তু বর্তমানে গমের আবাদ কম করছেন কৃষকরা। কারণ গমের তুলনায় অন্যান্য ফসলে প্রায় দ্বিগুণ টাকা আসে। তাই এখন গমের থেকে এদিকে আলু, ভূট্টাসহ বিভিন্ন ফসল ও সবজির আবাদ করছেন কৃষকরা।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভানোর ঝোলঝলি গ্রামের গম চাষি ফজলু বলেন, গমের আবাদ কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, বর্তমানে সার কীটনাশকের দাম অনেক বেশি। সেই তুলনায় গমের ফলন হয় না। আর অন্যান্য ফসল যেমন ভূট্টা গমের তুলনায় বেশি লাভজনক। তাই এইদিকের কৃষকরা বেশি করে ভূট্টা আবাদ করছেন। ৩৩ শতকের এক বিঘা জমিতে গম হয় ১০-১২ মণ। আবার গম কর্তন মৌসুমে গমের দাম থাকে কম। এছাড়াও অনেকে আবার গম ক্ষেত কেটে ঘাস হিসেবে বিক্রয় করে দিচ্ছেন। ওই জমিতে তারা চায়না ধান (বোরো ধান) লাগাচ্ছেন। তাতে লাভ হয় বেশি।

পীরগঞ্জ উপজেলার কৃষক বেগুনগাঁও গ্রামের মোকসেদ আলী গম ক্ষেত কেটে ঘাস হিসেবে বাজারে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এভাবে গম কাটার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘাস হিসেবে গম কেটে বিক্রি করলে দাম বেশি পাওয়া যায়। ৫০ শতকের এক বিঘা জমির গম ঘাস হিসেবে বিক্রয় করলে প্রায় ৮০ হাজার টাকা দাম পাওয়া যায়। আর এই জমিতে ভূট্টা লাগানো হবে। এতে আমাদের লাভ বেশি হয়।
একই গ্রামের মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, যেগুলো ক্ষেত খুব ঘন হয়ে গেছে। সেগুলো গম ভালো হবে না। তাই ওই সব গম ক্ষেত গরুর ঘাস হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে বিক্রি করলে আমাদের দ্বিগুণ লাভ হয়। তাতে এক বিঘা জমিতে টাকা পাই ৬০-৭০ হাজার আর গম করলে পাওয়া যাইত মাত্র ২০-৩০ হাজার টাকা। আর ঘাস হিসেবে গম ক্ষেত কেটে বিক্রি করায় গম লাগানোর ১ থেকে দেড় মাসের মধ্য জমিটা খালি হয়ে যায়। এই জমিতে আবার ভূট্টা চাষ করতে পারছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোচ্ছাম্মৎ শামীমা নাজনীন বলেন, ফলন ও দামের কারণে কৃষকরা মূলত গমের আবাদ কমিয়ে দিচ্ছেন। গমের আবাদ কম হলেও কৃষকরা কিন্তু জমি ফেলে রাখছেন না। তারা অন্যান্য ফসল চাষ করছেন। কৃষকরা যে ফসলে লাভবান বেশি হচ্ছেন তারা সেই সব ফসলে ঝুঁকছেন বেশি। আর যেসব গম ঘাস হিসেবে কেটে বিক্রয় বা গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে। সেসব গম আবাদের লক্ষমাত্রায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।
গম আবাদ বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের ভাতের থেকে গম খাওয়ার পরামর্শ অর্থাৎ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনসহ নানা পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে ও জেলার ৮ হাজার কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে বিনামূল্যে গমের বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

You may also like

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: মো. সাকের উল্লাহ

স্বত্ব © ২০২৪ দৈনিক লোকায়ন