প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ৬:২৮ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ জানুয়ারি ২৪, ২০২৪, ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ
মোঃ জাহিদ হাসান মিলু: কাঙ্খিত লক্ষ্যে ও স্বপ্নের শিউরে পৌঁছার চেষ্টায় কনকনে শীত এবং হিমেল হাওয়া ও নানা বাঁধাবিপত্তিকে উপেক্ষা করে পড়াশোনার পাশাপাশি অনুশীলন করে চলেছেন জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমির অনূর্ধ্ব ১০ থেকে শুরু করে অনূর্ধ্ব আটারোর অর্ধশত নারী ফুটবলাররা।
মেয়েদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো ও তাদের খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার ভোমরাদহ ইউনিয়নের জনগাঁও এলাকার দীপঙ্কর রায় (পরিমল) ও মোহন রায়সহ স্থানীয় কয়েকজন যুবকদের উদ্যোগে এবং পৃষ্ঠপোশকতায় ২০২১ সালে জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমির সুচনা হয়। হাটিহাটি পাপা করে ৩ বছর পেরিয়ে ৪ বছরে পর্দাপন করেছে একাডেমিটি। শুরুর দিকে এই একাডেমিতে মাত্র কয়েকজন থাকলেও বর্তমানে ৫০ জনের মতো নারী শিক্ষার্থীরা শারীরিক চর্চাসহ ফুটবল খেলার অনুশীলন করছেন।
এখান থেকে অনুশীলন করে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের টুর্নামেন্টে খেলেছেন এই একাডেমির নারী ফুটবলাররা। তাই কারও কোন কথায় কর্নপাত না করে দক্ষ খেলোয়ার হিসেবে জাতীয় পর্যায় ও দেশের গন্ডী পেড়িয়ে খেলার আশায় অদম্য ইচ্ছা শক্তিতে এবং স্বপ্ন পুরণের লক্ষ্যে প্রতিদিন মাঠে অনুশীলন করছেন তারা।
সরজমিনে গিয়ে দেখা ও জানা যায়, জনগাঁও ফুটবল একাডেমি মাঠে সুশৃঙ্খলভাবে ছোট শিশু ও কিশোরিদের ফুটবল অনুশীলন করতে। তবে আগে সকাল বেলায় ফুটবল খেলার অনুশীলন করলেও এখন কনকনে ঠান্ডার জন্য বিকালে অনুশীলন করছে।
পীরগঞ্জ উপজেলার দশম শ্রেণির ছাত্রী অনি। নিয়মিত অনুশীলন করেন জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমিতে। তিনি বলেন, গ্রামের মানুষ অনেক জনে অনেক কথা বলে যে, মেয়ে হয়ে কেন ছোট প্যান্ট ও জিন্সের ছোট কাপড় পড়ের ফুটবল খেলবা। এধরণের আরও নানা কটু কথা বলতো। আমি তাদের কথা কর্ণপাত না করে আমি আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাই আমি এখানে প্রতিদিন অনুশীলন করতে আসি। আমার আশা আমি এখান থেকে দক্ষ খেলোয়ার হয়ে জাতীয় দলে খেলতে চাই ও এলাকার সুনাম অর্জন করতে চাই।
জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমি দলের নেতা (ক্যাপ্টেন) তুলি রায়। তার বাড়ি জনগাঁও বিষ্ণপুর গ্রামে ও লোহাগাড়া ডিগ্রী কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। তিনি বলেন, এই একাডেমির যাত্রা শুরুর লগ্ন থেকে আমি এখানকার একজন সদস্য। তখন থেকেই আমি প্রতিদিন এখানে অনুশীলন করি। প্রথম দিকে অনুশীলন করতে আসতে আমাকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু তার পরেও আমি থেমে যায়নি। মানুষের কথায় আমি অনুশীলন বন্ধ করিনি। যারা আমাদের নিয়ে নানা খারাপ কথা বলছে। তারাই একদিন আমাদের সুনাম করবে। সেজন্য আমিও দেখিয়ে দিতে চাই যে নারীরাও ভালো কিছু করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, প্রথম দিকে আমাদের একাডেমির কোন ঘর ছিলনা। আমরা আগে সালোয়ার কামিজ (থ্রীপিস) পড়ে অনুশীলন করতাম। কোন জার্সি ও বুট ছিলনা। ধীরে ধীরে এখানে একাডেমির ঘর, পোশাক পরিবর্তনের ঘরসহ এখন আমরা বুট ও জার্সি পড়ে অনুশীলন করতে পারছি এবং এখানকার প্রশিক্ষকরা খুবই আন্তরিক ও আমাদের অনেক ভালো করে অনুশীলন করায়।
জনগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সৌরভী রাণী অনুশীলন করতে এসে তিনি বলেন, মানুষের কথায় কান না দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যেতে চাই। আমি জাতীয় দল ও দেশের বাইরে খেলতে চাই।
সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী দৃষ্টি রানী সোনা বলেন, আগে আমাদের এখানে নারীদের খেলার জন্য অনুশীলনের কোন যায়গা ছিলনা। এই একাডেমি হওয়াতে আমরা এখানে প্রাকটিস করতে পারছি। কিন্তু এখানে চাহিদার তুলনায় খেলার সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করতো তাহলে আমার আরও ভালো অনুশীলন করে ভালো পর্যায়ে যেতে পারবো।
মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে অভিভাবকদেরও শুনতে হয়েছে নানা কটু কথা। তবে এখানকার নারী ফুটবলাররা ভালো করায় এখন অভিভাবকরাসহ এলাকার মানুষও তাদের নিয়ে বেশ আশাবাদি।
তেমনি নরেন্দ্র নাথ রায় নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি বলেন, বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কথা বলতো নারীদের খেলা নিয়ে। এখন এই একাডেমিটা হওয়াতে আমাদের মেয়েরা এখানে খেলা শিখতে পারছে ও ভালো করছে। তাই এখন এলাকাবসীরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন ও তারাও নারীদের নিয়ে আশাবাদি যে, এখানকার মেয়েরা একদিন জাতীয় পর্যায়ে খেলবে ও এলাকার সুনাম ছড়াবে।
দীনেশচন্দ্র রায় বলেন, আমার মেয়ে এই একাডেমির একজন সদস্য সে প্রতিদিন এখানে অনুশীলন করে। এতে আমাকের এলাকার অনেক অনেক কিছু বলতো। তাই আমিও আমার মেয়েকে আসতে দিতে চাইতাম না। কিন্তু একাডেমির যারা আছেন তাদের প্রচেষ্টায় এখানকার নারী ফুটবলাররা বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে ভালো করেছে। তা শুনে এখন আমারও ভালো লাগছে। আমরা চাই এখানকার শিক্ষার্থীরা আরও ভালো পর্যায়ে যাক ও এলাকার মুখ উজ্জ্বল করুক।
এখানে শুধু শারীরিক চর্চা ও খেলার অনুশীলনই নয় এর পাশাপাশি তাদের সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিনা টাকায় বিভিন্ন বিষয়ে টিউশনও করতে পারছেন শিক্ষার্থীরা।
দশম শ্রেণির ছাত্রী আরতী রায় বলেন, জনগাঁও নারী একাডেমিতে আমরা শুধু খেলা শিখতে পারি না। এখানে সাংস্কৃতিক চর্চাসহ আমরা গান ও বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক আমরা টিউশন বিনা পয়সায় করতে পারছি। তাতে একদিকে আমরা পড়াশোনা ও অন্যদিকে খেলাধুলায়ও এগিয়ে যাচ্ছি।
এলাকার নারী ফুটবলারদের খেলায় আগ্রহ রয়েছে অনেক। এই একাডেমির ১৫ জন নারী ফুটবলার বিকেএসপির বিভিন্ন ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করেছে এবং বিকেএসপিতে স্থায়ীভাবে অনূর্ধ্ব ১৬ তে মেঘলা রানী খেলছেন। ইতি মধ্যে সে জাতীয় পর্যায়ে খেলার জন্য ডাক পেয়েছে বলে জানান, জনগাাঁও নারী ফুটবল একাডেমির প্রশিক্ষক (কোচ) শ্যামা প্রসাদ রায়।
একাডেমির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল চন্দ্র রায় বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামের নারীরা ফুটবল খেলবে এটি স্থানীয়রা ভালো চোখে নেননি। তাই শুরুর প্রথম দিকটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে পার করতে হয়েছে একাডেমির সংশ্লিষ্টদের। এখন সব ঝড়ঝনঞ্চা পেড়িয়ে পড়াশোনা থেকে শুরু করে খেলাধুলায় এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের একাডেমির নারীরা।
তিনি আরও বলেন, এখানে আমরা মেধাবী ও অর্থের অভাবে পিছিয়ে পড়া ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রতিমাসে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করি। এই অর্থ স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধা আলন চন্দ্র রায়ের তহবিল থেকে প্রদান করা হয়। এছাড়াও আমরা এখানকার সকল নারী সদস্যদের সেনিটারি ন্যাপকিন প্রদান করে থাকি।
সকলের সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশের নারী ফুটবল জগতকে পরিবর্তন করে আরও ভালো পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করেন এই একাডেমির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জুয়েল সরকার।
তবে একাডেমি পরিচালনা করতে ও ক্রিড়া সরঞ্জাম প্রদানে হিমশিম খেতে হচ্ছে একাডেমির সংশ্লিষ্টদের। তাই সমাজের বিত্তশালী সহ সরকার ও ক্রিড়া সংস্থার সহযোগিতা কামনা করেন জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমির সভাপতি মানিক চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, আমাদের এখানে যারা আছে তারা সবাই দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। আমরা চেয়েছিলাম এলাকার দরিদ্র পরিবারের নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই আমরা এই একাডেমিটি চালু করি। কিন্তু আগে আমাদের এখানে সদস্য সংখ্যা কম ছিল। এখন সদস্য সংখ্যা বাড়তেই আছে। আমাদের এখানকার মেয়ে গুলো দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় তারা পুষ্টিহীনতায় ভুগে বেশি। অনুশীলনের পরে তাদের যদি পুষ্টি কর খাবার সরবরাহ করা যেত তাহলে তাদের পুষ্টির ঘাটতি পুরণ হত।
তিনি আরও বলেন, এছাড়াও বিশেষ করে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে জার্সি ও বুট জুতা প্রদানে। কয়েক মাস পর পর তাদের জার্সি ও বুট জুতা পরিবর্তন করতে হয়। তাই যদি বিত্তশালীসহ সরকার ও ক্রীড়া সংস্থা আমাদের এবিষয়ে সহযোগিতা করতো তাহলে আমাদের এখানকার মেয়েরা এগিয়ে যেত ও আরও ভালো কিছু করতে পারবে এবং এলাকারসহ দেশের সুনাম অর্জনে তারা বড় ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন তিনিসহ একাডেমির সংশ্লিস্টরা।
জনগাঁও নারী ফুটবল একাডেমির নারী ফুটবলাদের জন্য প্রতিদিন স্বেচ্ছায় শ্রমদিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় প্রায় ৬-১০ জন মানুষ।