লোকায়ন ডেস্ক
৬০% হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের ভিড়/জাগো নিউজ
সংক্রামক বিভিন্ন রোগ নিয়ে হাসপাতালে আসে মানুষ। সব হাসপাতালেই লেগে থাকে স্বজনদের ভিড়। রোগী দেখতে এসেও কেউ কেউ হচ্ছেন নতুন রোগে আক্রান্ত। অনেকে রোগীর সেবা করতে গিয়েও হচ্ছেন রোগীর জন্য হুমকি। হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় ছড়িয়ে থাকা জীবাণুতেও আক্রান্ত হচ্ছেন রোগী কিংবা তার স্বজনরা। এক রোগ নিয়ে চিকিৎসা করাতে এসে আরেক রোগ নিয়ে ফেরা রোগীর সংখ্যাও কম নয়। দেশের হাসপাতালগুলোতে দুর্বল সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) ব্যবস্থাই এজন্য দায়ী।
ল্যানসেটের একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর বিশ্বের এক কোটি ৩৭ লাখ মানুষ মারা যায় সংক্রমণজনিত কারণে। এর বড় অংশ হাসপাতালে সংক্রমিত। অন্য আরেকটি গবেষণায় উঠে আসে, পশ্চিমা দেশগুলোতে এ ধরনের সংক্রমণ ৩ থেকে ৫ শতাংশ আর এশিয়ান দেশগুলোতে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এর মানে যেসব দেশে আইপিসি ব্যবস্থা ভালো সেখানে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার হার কম।
ছয় বিশেষজ্ঞের গবেষণা
সম্প্রতি মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছয়জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি দল দেশের সরকারি-বেসরকারি ও করপোরেট ৩৭টি হাসপাতালের সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে একটি গবেষণা করেন। এর মধ্যে ১১টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ১১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, ১১টি জাতীয় ইনস্টিটিউট ও চারটি করপোরেট হাসপাতাল। প্রতিটি হাসপাতালে একটি আইপিসি কমিটি রাখার নিয়ম আছে। যদিও অনেক হাসপাতালে কমিটির অস্তিত্ব মেলেনি।
গবেষণায় উঠে এসেছে, ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টিতে (৪০%) আইপিসি বেশি পর্যায়ে কিংবা কমিটিই নেই। অন্য ৯টি প্রতিষ্ঠানে (২৪.৩২ %) অপর্যাপ্ত বা কমিটি আছে কিন্তু বাস্তবে কার্যক্রম নেই। ৭টিতে (১৮.৯১%) আইপিসি ব্যবস্থা মাঝারি পর্যায়ের বা কমিটি আছে এবং কিছু কাজ হয়। দুটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও চারটি করপোরেট হাসপাতালে উন্নতমানের আইপিসি কন্ট্রোল করা হয় বা কমিটি এবং এর কার্যকারিতা রয়েছে।
যা বলছেন গবেষক
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক
ডা. মনজুরুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে এ গবেষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল হাসপাতালগুলোতে আইপিসি চলমান আছে কি না বা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না। আমরা এতে দেখতে পাই বেশিরভাগ হাসপাতালেই আইপিসি কমিটি আছে। তবে কমিটির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যক্রম নেই। যেমন নিয়মিত মিটিং করা, তদারকি করা হয় না।’
আমাদের ফুল টাইম আইপিসি প্রফেশনাল লাগবে। যেসব জায়গায় আইপিসি কমিটি নেই সেখানে আইপিসি কমিটি করতে হবে। যেখানে কমিটি থাকলেও কাজ হয় না সেখানে কার্যক্রম বাড়াতে বলা হয়েছে। গাইডলাইন (ওয়াশ ম্যানেজমেন্ট, অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন ইত্যাদি) মেনে চলতে হবে। আইপিসি রিলেটেড ট্রেনিং বাড়াতে হবে। এছাড়া মনিটর করার জন্য আলাদা লোক লাগবে।- ডা. মনজুরুল হক
এছাড়া জরিপে উঠে আসে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে ধরনের সংক্রমণ বেশি ঘটছে সেগুলোর স্ক্রিনিংয়ে প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। হেলথ কেয়ারে নিয়োজিতদের ট্রেনিংয়েও ঘাটতি। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কীভাবে ব্যবহার করা হবে এর একটি গাইডলাইন আছে। তবে হাসপাতালগুলোতে তা সঠিকভাবে মানা হয় না। এছাড়া চার ভাগের এক ভাগ হাসপাতালে হাত পরিষ্কার করার স্থান নেই। জনশক্তির ঘাটতি অনেক বেশি। ডব্লিউএইচওর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যতগুলো বেড ততগুলো রোগী থাকবে, কিন্তু সরকারি শতভাগ হাসপাতালে বেডের চেয়েও অনেক বেশি রোগী ভর্তি থাকে।
সরেজমিনে যা পাওয়া গেলো
রাজধানীর শেরেবাংলা নগর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২১২ নম্বর নারী ওয়ার্ডে গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, রোগী ও স্বজনরা একই বেডে শুয়ে আছেন। হাসপাতাল অবাধে ও অসতর্ক চলাফেরা সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়াতে পারে, সে বিষয়ে সঠিক পরিচর্যা নেই। তার ওপর নারী ওয়ার্ডে পুরুষ যাওয়ার নিয়ম না থাকলেও নারী রোগীর সঙ্গে বেডেই অবস্থান করছেন পুরুষরা। অনেকে নবজাতক, শিশু ও বৃদ্ধ স্বজনদের নিয়ে একই বেডে আছেন।
গত ২২ জানুয়ারি সিজারে নবজাতকের জন্ম দিয়েছেন হাসনা। তার সিজারের স্থানে সংক্রমণ ঘটায় নবজাতককে নিয়ে আবারও সোহরাওয়ার্দীতেই ভর্তি হয়েছেন তিনি। রোগীর সঙ্গে শুয়ে আছে তার নবজাতক। পাশে বসে আছে স্বামী। এসময় স্বামী মোফাজ্জলের নারী ওয়ার্ডে অবস্থানের কারণ ও হাসপাতালে একসঙ্গে থাকলে রোগীর কিংবা নিজেরও ক্ষতি হতে পারে- এ বিষয়ে জানেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে রোগ-জীবাণু থাকে জানি। সেভাবে মানা হয়নি। সরকারি হাসপাতালে নিজের স্বজনকে তো নিজেকেই দেখতে হবে। এ বিষয়ে ডাক্তার কিংবা নার্স কেউই কিছু জানাননি।’
পাশেই আরেক রোগী জান্নাত। সন্তান জন্মের আগেই মারা যায় তার। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার বিছানায় স্বামী ইমাম হোসেন ও তার মা বসে আছেন। এভাবে থাকলে রোগীর সংক্রমণ হতে পারে- এমন বিষয় সম্পর্কে জানেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল আগের চেয়ে পরিচ্ছন্ন। রোগ-জীবাণু আছে জানি। কিন্তু হাসপাতাল তো ব্যবস্থা নেয়নি। আমরাও এভাবেই চলছি।’
হাসপাতালের গাইনি বিভাগের নার্সরা জানান, আমাদের নার্সরা বেশিরভাগই ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোলের (আইপিসি) বিষয়ে জ্ঞান রাখে। তবে কাজে সেটি প্রয়োগ করা হয় না। সম্ভবও হয়ে ওঠে না।
হাসপাতালের সিনিয়র নার্স স্মৃতি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সকাল শুরু হয় ওয়ার্ডে অতিরিক্ত দর্শনার্থীদের বের করা, নোংরা করে রাখলে সেগুলো গোছানো- এসব নিয়ে। রোগীদের বোঝাই নোংরা কেন থাকেন, নোংরা থাকলে তো ইনফেকশন হবে। কিন্তু রোগী ও তাদের স্বজনরা কথা শোনেন না।’
সিনিয়র নার্স ফরিদা বলেন, ‘প্রতিটি গাইনি ওয়ার্ডেই পুরুষরা চলে আসেন। বের করলেও আবার আসেন। নার্সরা ইনফেকশন সম্পর্কে জানে। কিন্তু এসবের প্র্যাকটিস নেই। আমরা রোগীদের ম্যানেজ করতে পারছি না। কথা বললেও শোনে না। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
হাসপাতালের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের পার্ট-২ এর প্রধান অধ্যাপক ডা. আফরোজা গণি জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাসপাতালে অবাধে রোগী ও স্বজনদের উপস্থিতি ইনফেকশনের একটি বড় কারণ। অনেক সময় দেখা যায় একজন সংক্রামক রোগ নিয়ে এসেছেন, অন্যদের মধ্যেও ছড়াচ্ছেন। এ সংক্রমণ বন্ধ করতে হলে হাসপাতালে দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।’
আইপিসি ব্যবস্থা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এসেছে করোনাকালীন। এটি প্রথমে করোনা কেন্দ্র করে করা হলেও পরবর্তীসময়ে আমরা সেখানে অন্য হাসপাতালের সংক্রমণের বিষয়গুলো সংযুক্ত করেছি। হাসপাতালগুলোতে আইপিসি কমিটি আছে।- ডা. আবু হোসেন মোহাম্মদ মইনুল আহসান
হাসপাতালে আইপিসির জন্য কার্যকর কোনো কমিটি আছে কি না জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাসপাতালে সাত সদস্যের একটি কমিটি আছে। বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসক ও নার্সদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। তারা দেখভাল করে।’
কোনো মিটিং করা হয়েছে কি না কিংবা কোনো পরিকল্পনা করা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি চাকরিতে জয়েনের পর থেকে মিটিং হয়নি। তবে আমরা আবারও কাজ শুরু করছি এটি নিয়ে। আমি আসার পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ হাসপাতালের উন্নয়নে কাজ করছি। তবে মাত্রাতিরিক্ত লোড। ৫০০ শয্যা থাকলে ১৫শ রোগী থাকছে। ৫শ জনের জন্য জনবল দিয়ে দুই থেকে তিনগুণ রোগীর সেবা এবং হাসপাতাল পরিষ্কার রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ অনেক ইমোশনাল। আমরা চাইলেও দর্শনার্থীদের হাসপাতাল থেকে দূরে রাখতে পারি না। তারা তাদের রোগীর সঙ্গে চলে আসে। তবে আমি চেষ্টা করছি এ বিষয়গুলোতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার।’
সরেজমিনে রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। মেঝেতে বসে আছে মানুষ। হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগীর সঙ্গে স্বজন। অনেক জায়গায় অপরিচ্ছন্নতা। বক্ষব্যাধি একটি সংক্রামক রোগ। তবে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ওয়ার্ডে কিংবা আউটডোরে এ নিয়ে ছিল না কোনো সচেতনতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. খায়রুল আনাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে যত সংখ্যক রোগী তত সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। আউটসোর্সিং দিয়ে অনেক কাজ করাতে হয়। এক্ষেত্রে আইপিসি মেনটেইন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
আইপিসি ব্যবস্থা না থাকলে যে ধরনের সমস্যা বাড়বে
ডা. মনজুরুল হক বলেন, ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোল বিষয়টি সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে হাসপাতাল থেকে সংক্রমণ বেড়ে যাবে। হাসপাতালের সংক্রমণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেক বিপজ্জনক হয়। জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক হয়। একজন রোগী বাড়িতে থেকে ইনফেকটেড হলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হাসপাতালে এসে সংক্রমিত হলে। মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যাবে।
হাসপাতালে সংক্রমণ রোধে সমাধান
ডা. মনজুরুল হক বলেন, ‘আমাদের ফুল টাইম আইপিসি প্রফেশনাল লাগবে। যেসব জায়গায় আইপিসি কমিটি নেই সেখানে আইপিসি কমিটি করতে হবে। যেখানে কমিটি থাকলেও কাজ হয় না সেখানে কার্যক্রম বাড়াতে বলা হয়েছে। গাইডলাইন (ওয়াশ ম্যানেজমেন্ট, অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন ইত্যাদি) মেনে চলতে হবে। আইপিসি রিলেটেড ট্রেনিং বাড়াতে হবে। এছাড়া মনিটর করার জন্য আলাদা লোক লাগবে।’
আইপিসির জন্য ডেডিকেটেড কোনো লোক নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইপিসির যারা কাজ করেন তারা বেশিরভাগই অন্য নানা কাজে যুক্ত। নির্দিষ্টভাবে আইপিসি তদারকির জন্য কোনো লোক নেই।’
এ বিষয়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মোহাম্মদ মইনুল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইপিসি ব্যবস্থা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এসেছে করোনাকালীন। এটি প্রথমে করোনা কেন্দ্র করে করা হলেও পরবর্তীসময়ে আমরা সেখানে অন্য হাসপাতালের সংক্রমণের বিষয়গুলো সংযুক্ত করেছি। হাসপাতালগুলোতে আইপিসি কমিটি আছে।’
আইপিসি কমিটি থাকলেও কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে না স্বীকার করে বলেন, ‘করোনার সময় এ কমিটি গঠন করায় অনেক ক্ষেত্রে কমিটিতে থাকা জনবলের অনেককে অন্য জায়গায় প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে আইপিসির কার্যক্রম কিছুটা কমেছে। আইপিসি কমিটি সক্রিয় করলে আশাকরি হাসপাতালগুলোতে সংক্রমণ কমে আসবে।’