১৫০
রাফিকা তাবাসসুম
বগুড়ার দই খাননি এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম,কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যাননি এমন মানুষ ও হাতে গোনা যাবে।ঠাকুরগাঁও গিয়েছেন কি?চলুন আজ আমার চোখে ভ্রমণ করে আসা যাক প্রাণের শহর ঠাকুরগাঁও । উত্তরের কুলিক নদীর তীর ঘেঁষে এই শহরের মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে ।ঠাকুরগাঁও এর আদিনাম নিশ্চিন্তপুর বলেই লোকমুখে শোনা যায়।এই শহরের মানুষগুলো অনেক শান্তি প্রিয় ও সাধারণ।ঠাকুরগাঁও নামটি শুনলে মনে হয় এটি একটি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা কিংবা ঠাকুর দেবতার আধিপত্য বিরাজমান।ব্রাক্ষণ দের আধিপত্যের কারণে নিশ্চিন্তপুরের নামকরণ করা হয় ঠাকুরগাঁও।আগে রাজধানী ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও যেতে হলে বেশ ভোগান্তির সম্মুখীন হতো যাত্রীরা। তবে ,এখন যাতায়াত ব্যবস্থা অনেকটাই উন্নত হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও যেতে হলে মহাসড়ক পথে টাঙ্গাইল ,সিরাজগঞ্জ,পাবনা ,বগুড়া ,গাইবান্ধা,রংপুর এবং দিনাজপুর জেলা পেরিয়ে যেতে হয়। ঠাকুরগাঁও এ কোনো নদীপথ নেই।হিমালয়ের পাদভূমিতে প্রকৃতির অপার সম্ভারে সজ্জিত মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ঠাকুরগাঁও এর অবস্থান। ঠাকুরগাঁও এর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত টাঙ্গন ব্রিজের উপর থেকে কখনে কখনো রৌদ্দজ্বল আকাশে হিমালয়ের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। ঠাকুরগাঁও এর সৌন্দর্য একেক ঋতুতে একেক রকম।গ্রীষ্মে মাঠ ভরে থাকে সোনালি ফসলে ,বর্ষায় টাঙ্গন নদীর জল থৈ থৈ করে,শরৎ এ দুই ধারে কাশ ফুল ,নীল আকাশ,হেমন্তে গৃহস্থ বাড়িতে ফসল কাটার মৌসুম সব মিলিয়ে বছরের ছয় ঋতুতে ছয় রূপে বর্ণিল ভাবে সেজে উঠে ঠাকুরগাঁও । শীতকালে উত্তরের শীতল হাওয়া শরীর স্পর্শ করলেই অন্যরকম এক স্নিগ্ধতার অনুভূতি জাগে । আকাশের শেষ সীমানা থেকে উঁকি দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা । দেখে যেন মনে হয় মেঘের রাজ্য থেকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে।বসন্তে কোকিলের মিষ্টি সুরে সকালের শুরু হয় এখানকার মানুষদের।এই অঞ্চলের রয়েছে নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা। যা এসেছে রাজবংশী ভাষা থেকে এবং এই ভাষাতেই উক্ত অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ তাদের ভাবের আদান প্রদান করে থাকে। এক সময় ঠাকুরগাঁও এর হাতে গোনা কিছু মানুষের ঘরে টেলিভিশন ছিলো।৯০ দশকের প্রথমার্ধে ধনী গরীব সকলের বাসায় টেলিভিশন পৌঁছে গেছে।ঠাকুরগাঁও এ ৭০’ র দশকের শেষ দিক থেকে মোটর সাইকেলের ব্যাবহার শুরু হতে থাকে।বর্তমান সময় এ জেলার মানুষের বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় বাহন মোটর সাইকেল।২০০৩ সালের মে মাসে ঠাকুরগাঁও এ মোবাইল নেটওর্য়াক এর যাত্রা শুরু হয়।এক সময় এই শহরের মানুষেরা মাটির সানকি বাসন কোসন ব্যাবহার করতো যার প্রচলন এখন আর নেই ।ঠাকুরগাঁও এর প্রায় সকলের বাড়িতেই চৌকি আছে। ঠাকুরগাঁও জেলা সূর্যাপুরী আমের জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলের বিখ্যাত কিছু খাবার:পাট শাক ,লাফা শাকের ঝোল,সিদলের ভর্তা,পেল্কা।যা এই অঞ্চলের মানুষের মুখরোচক খাবারের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে । এই শহরের মানুষ অনেক অতিথি পরায়ণ।ঠাকুরগাঁও এ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছ। যার সংখ্যা১৫ হাজার ৫১১ জন।এই জেলার নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো হলো সাঁওতাল,ওঁরাও,পলিয়া ,কোচ রাজবংশী।এরা আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি নিজেদের ভাষাও ব্যবহার করে থাকে।ধামের গান আমাদের নিজস্ব সম্পদ।আশ্বিন ,কার্তিক ,অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামে ধামের গানের আসর বসে। বিভিন্ন পূজার সময় ধামের গানের আসর বসে।এছাড়াও ভাওয়াইয়া,পালাগান ,পল্লিগীতি,কবূজার, কোয়ালি গান,বিষহরি গান ,কির্তন সত্যপীরের গান বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণে গাওয়া হয়।এই শহরে রয়েছে কুম্ভকার ,কর্মকার ,স্বর্ণকার,,জেলে তাঁতী,কাঠমিস্ত্রি ,রাজমিস্ত্রি। মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে।ঠাকুরগাঁও এর মানুষ অনেক সংস্কৃতিমনা।১৯৮৭ সালের দিকে ঠাকুরগাঁও এ শিল্পকলা একাডেমি গঠন করা হয়েছিল।তখন নাম ছিলো শিল্পকলা পরিষদ।১৯৭৯ সালের দিকে পরিষদের নতুন কমিটি গঠন করা হয়।এই কমিটির সিদ্ধান্তে উষসী পত্রিকার জন্ম হলো।৮ পৃষ্ঠার পত্রিকার দাম ৫০ পয়সা।সেটা ছিলো ঠাকুরগাঁও এর প্রথম পত্রিকা।১৯৭৫ সালের পর থেকে নিয়মিত নাট্যচর্চা শুরু হয় এই ছোট্ট শহরটিতে।ঠাকুরগাঁও এ বেশ কিছু ক্রিড়া সংগঠন রয়েছে।আগমনী স্পোর্টিং ক্লাব ,সাম্য ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী,সরকারপাড়া আজাদ ক্লাব , টাউন ক্লাব ,আশ্রম পাড়া তরুণ সংঘ ইত্যাদি।শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঠাকুরগাঁও এ চিনি কল অন্যতম।এছাড়াও রয়েছে বিসিক শিল্প নগরী,সেখানে কিছু কারখানা রয়েছে।ঠাকুরগাঁও এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর সংখ্যা : ১ টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবিত, ১ টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ,ডিগ্রি কলেজ ১৮ টি,ইন্টারমেডিয়েট কলেজ ২৭ টি ,মহাবিদ্যালয় ৪৬ টি,পলিটেকনিক ইন্সটিটউট এক টি,কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এক টি,মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৩৯ টি,মাদ্রাসা ১৬৯ টি।ঠাকুরগাঁও এ অনেকগুলো নদী রয়েছে। টাঙ্ন নদী,ছোট ঢেপা নদী,কুলিক নদী,পুনর্ভবা নদী,তালমা নদী,পাথরাজ নদী,কাহালাই নদী,নোনা নদী,শুক নদী,ভুল্লি নদী । ঠাকুরগাঁও এর বালিয়াডাঙ্গি উপজেলায় অবস্থিত আম গাছ এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় আম গাছ।বাংলাদেশের প্রান্তিক শ্রমজীবি মানুষের জীবনবৈচিত্র ও গ্রামীণ লোকজ সংস্কৃতি সংরক্ষার্থে ঠাকুরগাঁও এর পূর্ব আকচা গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে গড়ে তোলা হয়েছে এই জাদুঘর।ঠাকুরগাঁও জেলায় অবপ্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হলো জামালপুর জামে মসজিদ বা জামালপুর জমিদার বাড়ি।এছাড়াও ঠাকুরগাঁও এ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। বালিয়া মসজিদ,রাজভিটা,রাজা টংকনাথের বাড়ি,হরিপুর রাজবাড়ি,জগদল রাজবাড়ি ইতইত্যাদি। ঠাকুরগাঁও জেলার উল্লেখযোগ্য দিঘীগুলো হলো-গড়েয়া হাট দিঘি ,লস্করা দিঘি,শাসলা ওপেয়ালা দিঘি,রামরাই দিঘি ,খুনিয়া দিঘি। এরমধ্যে রামরাই দিঘি সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ।ঠাকুরগাঁও এ উৎসব পার্বণে বিভিন্ন রকম মেলা অনুষ্ঠিত হয়।এসব মেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেকমরদ মেলা,বারুনির মেলা,হরিপুর রাঘব মেলা,নাককাটির মেলা ,কালিমেলা ,রুহিয়া আজাদ মেলা ইত্যাদি।এই শহর এর প্রধান প্রধান হাটবাজার সমূহ – নেকমরদ হাট,কালিবাড়ী বাজার,শিবগঞ্জ বাজার,রুহিয়া রামনাথ হাট,গড়েয়া হাট,যাদুরানি হাট।ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় ঠাকুরগাঁও এর মাটি ও মানুষ দৃষ্টান্ত স্বরুপ।জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন স্পর্শ কাতর ইস্যু তৈরী হলেও ঠাকুরগাঁও এ তার প্রতিফলন ঘটেনি।এখানকার মানুষ বরাবরই শান্তি প্রিয়।প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শওকত আলীর ‘নাঢ়াই’ গ্রন্থে ঠাকুরগাঁওয়ের ফুলমতি উঠোনে দাঁড়িয়ে সুখের ছবি দেখেছিলো।এমন সুখ -শান্তিতেই জীবন কাটাতে চায় ঠাকুরগাঁও নামক ছোট্ট শহরের মানুষগুলো।এই শহর আমাকে শান্তি দেয়,স্বস্তি দেয়।
লেখক: ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস, ১ম বর্ষ