১১১
বিশেষ প্রতিনিধি পঞ্চগড়
উত্তরের হিমলয়ান সমতল ভূমি বেষ্টিত অঞ্চল পঞ্চগড় জেলা। এ জন্য এই জেলাকে হিমালয় কন্যা বলা হয়। নদী গবেষকদের মতে এই জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট বড় ৪৬ টি নদী। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে নদীর সংখ্যা ৩৩। পাহাড়ি সমতল অঞ্চল হওয়ায় কিছু নদী বয়ে এসেছে ভারতের পর্বতাঞ্চল থেকে । ২৯ নদীর উৎপত্তি ঘটেছে এই জেলার খাল বিল থেকে। বাংলাদেশের অন্য কোন জেলার উপর দিয়ে এতো নদী প্রবাহিত হয়নি। তাই অনেকে পঞ্চগড়কে নদীর জেলা বলে থাকেন। এই নদী গুলো সুদীর্ঘকাল ধরে এই জেলার সংস্কৃতি ও কৃষি নির্ভর অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে আসছে। নদীগুলোর অপার প্রতিদানে এই জেলার মাটি অত্যন্ত উর্বর। এই জেলার পানি বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষুদ্ধ এবং স্বুসাদু। তাই এখানে সবধরনের ফল ফশলের আবাদ হচ্ছে। কিন্তু ধিরে ধিরে নদীগুলো বিলিন হয়ে হয়ে যাচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে শুকিয়ে যাচ্ছে নদী। মরা নদীতে রুপান্তরিত হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন একযুগ আগেও এসব নদীতে সারাবছর পানি থাকতো।পাওয়া যেতো নানা ধরনের দেশী মাছ। বর্তমানে অধিকাংশ নদী জল শুন্য হয়ে পড়েছে। এসব নদীতে চাষ করা হচ্ছে বোরো আবাদ । নদীগুলোতে বোরো আবাদ করার ফলে ব্যবহার করা হচ্ছে অতিরিক্ত সার এবং কিটনাশক।সার কিটনাশকের প্রভাবে মাছের প্রজনন হচ্ছেনা। হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতীর মাছ।সংশ্লিষ্টরা বলছেন ইতোমধ্যে বেশ কয়েক প্রজাতীর মাছ হারিয়ে গেছে। অপরিকল্পিতভাবে চাষাবাদের ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। ফলে গতিপথ বদলে যাচ্ছে ।
পঞ্চগড়ে আন্তসীমান্ত নদী ৮টি । মহানন্দা, করোতোয়া,ডাহুক ,তালমা , টাঙ্গন ,ঘোড়ামারা, বুড়ি তিস্তা এবং নাগর। তালিকা বহির্ভূত আন্তসীমান্ত ৯টি আন্তসীমান্ত নদী হলো বেরং,কুড়ুম,চাওয়াই,ছোট যমুনা,পাঙ্গা,আলাই কুমারী ,ভাতা ,গোবরা এবং সাঁও। পঞ্চগড়ের বিভিন্ন খালবিল থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীগুলো হলো ভেরসা ,খরখরিয়া, ঘাগরা,বোরকা,ঝিনাইকুঁড়ি,ছেতনাই, শিঙ্গিয়া বা বহু নদী,হুয়ারী বা হঠাৎ নদী, কাঠগিরি ,বাঘমারা ,ডারি , চিলকা, বহিতা, শালমাড়া, তিস্তা, ভাঙ্গা ,পাইকানী, পাম নদী, পাথরাজ, আতরাই,ভূল্লি,পাথরাজ, রসেয়া ,তীরনই ,রনচন্ডি , জোড়াপানি ,সুই নদী , পেটকি এবং দারা। এছাড়া কালিদহ এবং পাইলাভাসা নামেও দুটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। অন্য কোন জেলায় এতো নদী প্রবাহিত হয়নি
অধিকাংশ নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে হাট বাজার, জেলা ও উপজেলা শহর। অপরিকল্পিতভাবে ভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে মানচিত্র থেকে নিশ্চির্ণ হয়ে যাচ্ছে ডাহুক নদ। ওই এলাকার একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এই পাথর উত্তোলনের সাথে জড়িত। প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরকে ম্যানেজ করে থোলা নদী দখল করে পাথর উত্তোলন করছে তারা। তালমা নদীর পাশেই গড়ে উঠেছে কয়েকটি বাজার। এই বাজারের সকল ময়লা ফেলা হচ্ছে নদীতে। হাড়িভাসা ও চাকলা বাজারের ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে কুরুম নদীতে। বোদা উপজেলা শহর গড়ে উঠেছে পাথরাজ নদীর তিরে। উপজেলা শহরের সকল হোটেল সহ সব ধরনের দোকান পাটের ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এই নদীতে। নদীটি মরে যাওয়ার পথে। দেবীগঞ্জ এবং পঞ্চগড় শহর গড়ে উঠেছে করোতোয়া নদীর তীরে। এই দুই বৃহৎ শহরের সমস্ত ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে করোতোয়ায়। হাসপাতাল, ক্লিনিকের ময়লা আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে এই নদীতে। গোবরা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে সীমান্ত উপজেলা শহর তেতুলিয়া । এই শহরের সকল ময়লা আবর্জনা ফেলা হয় এই নদীতে। নদীটি প্রায় মৃত। এই উপজেলার তীরনই হাট বাজার গড়ে উঠেছে তীরনই নদীর তীরে। এই বাজারের সকল ময়লা আবর্জনা ফেলা হয় ওই নদীতেই। ভারতের শিলিগুড়ি শহরের সকল বর্জ্য ফেলা হয় মহানন্দা নদীতে। তাই মহানন্দার পানিও দুষিত। অন্যান্য নদীর তীরে গড়ে ওঠা হাটবাজারের ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতেই। ফলে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দুষিত হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক কোন উদ্যোগ নেই। নেই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কোন উদ্যোগ। ফলে নদী গুলো ধিরে ধিরে বিলিীন হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে মাছ সহ জলজ প্রাণী।পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। চাষাবাদেও দেখা দিয়েছে মলিনতা। কারণ নদী শুকিয়ে যাবার ফলে সেচ দিয়ে পানি দিতে হচ্ছে।ফলে চাষাবাদে খরচের মাত্রা বেড়ে গেছে।
এদিকে নদী দখল করে অনেকে গড়ে তুলছে ভবন, দোকান পাট, ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সদর উপজেলার হাড়ি ভাষা এলাকায় কুরুম নদী দখল করে গড়ে উঠছে দোকান, প্রতিনিয়ত হচ্ছে চাষাবাদ। ডাহুক নদ দখল করে কয়েকটি কোম্পানী গড়ে তুলেছে কারখানা,রিসোর্ট,পল্ট্রি ফার্ম। জেলা শহরের উপকন্ঠে তালমা নদী দখল করে গড়ে উঠেছে পার্ক, ভবন এবং ব্যাবসায়ি প্রতিষ্ঠান। তেতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর এলাকায় করোতোয়া নদী দখল করে গড়ে উঠেছে চা বাগান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বসত বাড়ি। নদী দখল করে চলছে অবৈধভাবে পাথর ও বালি উত্তোলন। দখলের ফলে এসব নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে। প্রবাহমান স্রোতধারা সংর্কির্ণ হয়ে পড়েছে। পঞ্চগড়ে প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সংগঠন কারিগরের সভাপতি সরকার হায়দার দৈনিক লোকায়ন কে জানান, নদী দখল এবং দুষণ দুটোই ক্রমাগত বাড়ছে। নদীর বুকে চাষাবাদের ফলে স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পরছে জীবন জীবিকায়। প্রশাসনিক সহ সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন ।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকি বলেন, পঞ্চগড়ে ৪৬ টি নদী আমার গবেষণায় উঠে এসেছে। অনেক নদী দখল আছে যা খালি চোখে দেখা যায়না। করোতোয়া এবং পাথরাজ নদী সবচেয়ে দুষিত হয়ে পড়ছে। নদীগুলো নিয়ে রাষ্ট্রিয় পরিচর্যার অভাব রয়েছে। পরিকল্পিত ভাবে খনন দরকার।
জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বলেন নদী নিয়ে আমাদের উদ্যোগ আছে। বেশ কিছু নদীর খনন হয়েছে এবং আরও খনন হবে। এ ব্যাপারে সকলের সচেতনতা জরুরী। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সকল স্তরের মানুষের এগিয়ে আসা দরকার ।