বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও জেলা শহর ছোট শহর হলেও এটি অত্যন্ত পরিপাটি। এ শহরে বেশ কয়েকটি ভারী শিল্প কারখানা রয়েছে। ভারী শিল্প কারখানা গুলোর মধ্য চিনি শিল্প একটি।
চিনি শিল্পের জন্য ঠাকুরগাঁও বিখ্যাত। “ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস” প্রতিষ্ঠানটি ঠাকুরগাঁও রোডে অবস্থিত।এটি ১৯৫৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু করে ১৯৫৮ সালে শেষ হয়। মূল শহর থেকে এটি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
চিনি শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হলো আখ। এই আখ আশেপাশের এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এছাড়া সুগার মিলস এর রয়েছে নিজস্ব বেশ কিছু জমি যাতে তারা আখ উৎপাদন করে থাকে চিনি শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তবে সুগার মিলের বেশ কিছু ব্যাতিক্রমী কাজ করে থাকে যা সকলের নজর কাড়ে ও মনে সুন্দর ভাবনার উদয় হয়।
খেজুর বাগান হলো এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ঠাকুরগাঁও শহরের কালি বাড়ি ওয়াবদা রোড ধরে সত্যপীর ব্রিজ। ব্রিজের রাস্তা দিয়ে ঠিক উত্তর দিকে মুন্সীর মোড় ।এ মোড়ের সোজা প্রশস্ত রাস্তা পারি জমালে শুধু খেজুর বাগানই দেখতে পাওয়া যাবে এমন ভাবনা থাকলে অনেক ভুল হয়ে যাবে। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।
নারগুন কহর পারা পার হয়ে খেজুর বাগান। কহর পারা পার হবার সময় আমাদের গাইড রফিকুল ইসলামের কাছে জানলাম কহর পাড়ার ইতিহাস। কহর পাড়ায় পূর্বে শুধুমাত্র কচুর চাষ করা হতো। এমন একটা সময় ছিল যখন এ অঞ্চলের মানুষ কচুর তরকারি, কচুর মুরা সিদ্ধ করে গুর কিংবা মরিচের ভর্তা দিয়ে খেত। এ জন্য নাকি এ অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের বিয়ের জন্য অনেক সমস্যায় পড়তে হতো। এমন সব গল্প শুনতে শুনতে আমরা প্রায় খেজুর বাগানের কাছাকাছি। আমাদের গাইড বললেন, এখানে না নেমে আগে আপনারা গোলাপ বাগান দেখেন। গোলাপ বাগান খেজুর বাগান থেকে আধা কিলোমিটার দূরের রাস্তা হবে। আমরা গোলাপ বাগানের খবর জানতাম না। অচেনা অজানা রাস্তা হলেও রফিকুল ইসলাম এর কথা শুনে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা যায় এমন। তাই আমরা কোন ভয় না পেয়ে তার সাথে এগিয়ে গেলাম।
আমাদের গাড়ি নালা হাটি ব্রিজ পার হয় থামলো বোচা পুকুর নামক স্থানে। যদিও আশেপাশে কোন পুকুর চোখে পড়লো না। এ রাস্তায় মানুষজন, গাড়ি ঘোড়ার তেমন একটা ব্যস্ততা নেই। অনেক কোলাহল মুক্ত আর নিরিবিলি এলাকা ।
পাকা সড়কের কাছে গাড়ি থামিয়ে আমরা আল ভাঙ্গা মাটির পথ ধরে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই মন আনন্দে প্রজাপতির ডানায় উড়ে যেতে লাগলো। কি অপরূপ গোলাপ আর গাঁদা ফুলের বাগান। বাতাসে সুরভী ছড়ানো। মন খুশিতে ভরে গেল। মনে হলো আরো কিছু সময় হাতে নিয়ে কেন এলাম না। আমাদের সাথে ছিল একজোড়া নব দম্পতি। তারা নিজেদের সেলফি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
পড়ন্ত বিকেলের রাঙা আকাশ, ছোট ছোট হলুদ রঙের শত শত হলুদ গাঁদার ফুল আর সাদা ও গোলাপী রঙের গোলাপ ফুলেদের মিতালি পাশে হেলানো বাঁশ ঝাড় সব মিলিয়ে অপূর্ব এক বিকেল। কথাকলিরা আনন্দে হারাতে লাগলো ফুলেদের পাঁপড়িতে। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম।
উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেশি। সারাদিন ভীষন কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। তাই আমরা দুপুরের খাওয়া শেষ করে বের হয়েছিলাম। তাতেও খুব একটা ভালো ফলাফল হলো না।আমাদের সাথে সাথে কুয়শাও চারদিকে এসে হাজির । কুয়াশা সাথে থাকাতে ভ্রমণটায় আলাদা একটা আনন্দের মাত্রা যোগ হয়েছিল। আমাদের গাইড রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের মজা দেখছিলেন। আমরা গোলাপ বাগানে কিছুটা সময় থেকে খেজুর বাগানের দিকে রওনা হলাম। পথের দুপাশে প্রচুর ইক্ষু ক্ষেত। গাইড রফিকুল ইসলাম জানালেন, এই ইক্ষু ক্ষেত গুলো সুগার মিলের নিজস্ব ভূমি।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের গাড়ি খেজুর বাগানের দিকে এসে পৌঁছাল। খেজুর বাগানের প্রবেশের দৃশ্য দেখে এক চমৎকার চিন্তা মনে কাজ করতে লাগলো। সারি সারি খেজুর গাছের মাঝে সবুজে সবুজ মিলেমিশে একাকার হয়ে ছেয়ে আছে গমের কচি চারা গাছগুলো। কি অপূর্ব উৎপাদন প্রক্রিয়া। একদিকে খেজুরের রস, আবার তা থেকে খেজুরের দানা গুড়, ঝোলা গুড়। আবার খেজুর গাছের নিচে গম উৎপাদন। সত্যি বুদ্ধিমত্তায় প্রশংসা না করে পারা যায় না।
আমরা বাগানের ভেতরের দিকে যেতে যেতে আরো অভিভূত হলাম। প্রতিটির ছোট বড় খেজুর গাছ বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে লাগানো। খেজুরের গাছের রস কাটার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসে। যা টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিক করা হয়। কারা খেজুর গাছের রস কাটবে। যারা রস কাটার জন্য নির্ধারিত হয় তারা খেজুর বাগানেই রাত্রি যাপন করে। উচু বাঁশের মাচা তৈরি করে সেখানে শীতের রাতে বিছানা পেতে অনেক কষ্টের জীবন যাপন করেন।
গাছিয়ারা নিপুণ হাতে গাছ প্রস্তুত করে তাতে বাঁশের নল সেট করেন ও একটি করে মাটির হাঁড়ি বেঁধে দেন। সেই হাঁড়িতে রস ফোঁটায় ফোঁটায় জমা হয়। রস স্বাস্থ্যসম্মত রাখার জন্য খেজুর গাছের গায়ে নীল রঙের জাল বেঁধে দেন।
নিজেদের কষ্টকে তুচ্ছ মনে করে তারা মানুষের সেবায় কাজ করে যান। খেজুর গুড় বানানোর জন্য সেখানেই লম্বা আকারের বড় বড় মাটির চুলা তৈরি করে ।খেজুর গাছে বাঁধা মাটির হাড়িগুলো একে একে নামিয়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করেন এরপর সেই রস কয়েক ঘণ্টা জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে খেজুর গুড় বানান। জাল দেবার পর এই খেজুর রসের ঘনত্ব অনুযায়ী গুড়ের নাম ধারন করে। যেমন; পাটালি,বাটালি,পাটা,নালি,ঝোলা ইত্যাদি। সবার মনে এই গুড়ের স্থান মনের মনিকোঠায়। শুধু গুড় নয় অনেকের এ রসের প্রতি রয়েছে প্রবল আকর্ষণ।
বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ছুটে আসেন এই খেজুর বাগান দেখতে ও খাঁটি খেজুর রস ও খাঁটি খেজুর গুড় পেতে।
বাঙালির জীবনে গুড়ের ব্যাবহার বেশ পুরনো।শীতের সময় বাড়িতে বাড়িতে ধুম পড়ে যায় খেজুর রস ও খেজুর গুড়ের পায়েস,খেজুর গুড়ের দুধ চিতুই, দুধ পুলি বানানোর। আর এসব পিঠা যেদিন বানানো হয় সেদিন বাড়ি মৌ মৌ গন্ধে ভরে যায় আর বাড়ির সকলের মন হাসিখুশিতে ভরে থাকে।বাঙালি মনের এই সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের এই খেজুর বাগান।
খেজুর বাগান এতটাই বিস্তৃত যে এ বাগান দেখাশোনার জন্য রয়েছে প্রায় আট দশ জন মানুষ। বাগানের বিভিন্ন জায়গায় তাবু টাঙানো। বাগান ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়লো শুধু গম চাষ নয় খেজুর বাগানে চাষ করা হয়ছে আলু, মরিচ, মাচা টেনে লাউ। প্রতিটি সবজি ক্ষেত সতেজ সবুজ। নাগরিক জীবনের কোলাহল ছেড়ে এ এক প্রশান্তির জায়গা।
আমাদের দেশে খেজুর গুড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে তবে এর তুলনায় খেজুর বাগানের সংখ্যা অনেক কম। তাই প্রত্যেকেই একটি খেজুর গাছের বীজ বপন করে আমরা আমাদের চাহিদা পূরনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমরা বাড়ি ফিরার জন্য গাড়ি ঘুরালাম কিন্তু আযানের মধুর সুর কানে এলো। আমাদের সাথে থাকা আব্দুল কাইয়ুম নামাজের জন্য মসজিদে নেমে পড়লো। মহিলাদের জন্য নামাজের সুব্যবস্থা না থাকায় আমরা ফেসরাডাঙ্গী ব্রীজ দেখতে গেলাম। ব্রীজের নিচে বালু উত্তোলনের কাজ চলছিল। আঁধার ঘনিয়ে এলো। দু চারটা মোটর বাইক দ্রুত ঘরে ফিরতেদেখা গেল। এ ব্রীজ পীরগঞ্জ,শিবগঞ্জ এলাকার মানুষের সাথে ঠাকুরগায়ের মানুষের এক বন্ধুত্ত্বের অপূর্ব মেল বন্ধন সৃষ্টি করেছে।
আব্দুল কাইয়ুম ফিরে এলেই আমরা ভাপা পিঠার দোকান থেকে খেজুর গুড় দেওয়া ভাপা পিঠা নিয়ে খুশি খুশি বাড়ি ফিরলাম।