৩৩
আব্দুল আউয়াল, শহর সংবাদদাতা: ধামের গান আদতে ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় অঞ্চলের স্থানীয় লোকনাট্যের একটি ধারা যা কালের গর্ভে এখনও হারিয়ে যায়নি। এ লোকনাট্য ধারাটি এই অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনে সব ধর্মের, বয়সের সাধারণ মানুষের বিনোদনের এক নির্মল উৎস।
হেমন্তের শেষ দিকে শুরু হয়ে শীতের শুরু পর্যন্ত ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে শত বছরের প্রাচীন এ লোকনাট্য গানের আসর বসে।
এরই ধারাবাহিতায় এবারও ধামের গানে আয়োজনে মেতে উঠেছে ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামাঞ্চল। রাতভর চলা মন মাতানো এই আয়োজনে তৈরি হচ্ছে এক উৎসব মুখর পরিবেশ। যন্ত্রীরা সাধারণত মঞ্চের মাঝখানে গোল হয়ে বসে ঢোল, খঞ্জনি, একতারা, খোল, বাঁশি, হারমোনিয়ামের শব্দে গান তুলে মুখরিত করছেন পুরো এলাকা।
অনেকটা সৌখিনতার স্বাদে জমকালো ভাবেই আয়োজন হয় এই ধামের গান উৎসব। রঙ-বেরঙের কাপড় টাঙিয়ে ও মাটির উঁচু ঢিবির চারপাশে বাঁশের ঘের দিয়ে বানানো হয় মঞ্চ। সেখানে রাতভর অভিনয় সহকারে গান গাওয়া হয়।
পালাগুলোর ব্যাপ্তি গল্পভেদে কয়েক ঘণ্টা হয়ে থাকে। একরাতে তিন-চারটি পালা অনুষ্ঠিত হয়। একেকটি দল এসে একেক পালা পরিবেশন করে। কোন কোন আসর সপ্তাহব্যাপী চলে। ধামের গান উপলক্ষে জন সমাগম কিছুটা লোকজ মেলারও আকার ধারণ করে।
দৈনন্দিন জীবন যাপনের নানা উপকরণ নিয়েই গল্প ও গান তৈরি হয়। প্রান্তিক কিংবা সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, সাংসারিক জটিলতা, প্রেম, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের অবহেলা, দুশ্চরিত্রের লাম্পট্য সহ যাবতীয় বিষয়াদি অত্যন্ত সরল সহজভাবে উঠে আসে এসব গানে। জটিল বিষয়গুলোকেও হাস্যরসের মাধ্যমে চিত্তাকর্ষক করে তোলা হয় অভিনয়ের মাধ্যমে।
ধামের গানের শিল্পীদের তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ থাকেনা। এঁরা আহামরি কোন পেশাদার অভিনেতাও নন। অত্যন্ত চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে এরা বর্গাচাষি, দিন মজুর, ভ্যানচালক, রাজমিস্ত্রীর জোগালি ইত্যাদি সাধারণ পেশার লোক। এসব গানের আসরের কোন পাণ্ডুলিপিও হয় না, থাকে না যাত্রাপালার বা মঞ্চ নাটকের মতো কোনো প্রম্পটার। প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলী থেকেই নেওয়া হয় চরিত্রগুলো। ধামের গান পরিবেশিত হয় আঞ্চলিক ভাষাতেই । এর বিষয়বস্তু হল প্রতিদিনের চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ এবং তা খুবই জীবন্ত ও সাহিত্যিক মারপ্যাঁচ শূন্য। এ কারণে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ধামের গানের আসক্তি ও জনপ্রিয়তা অন্য সব লোকনাট্য থেকে অনেক বেশি।
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও আকচার গ্রামে একটি ধামের গানের আয়োজনে গেলে কথা হয় শিল্পী নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে। নরেন্দ্রের বাপ দাদাও এই গানের শিল্পী ছিলেন। বাবার হাত ধরে শিশু কালেই তিনি ধামের গানের সঙ্গে জড়িয়ে যান।
নরেন্দ্র জানায়, সখের বসেই তিনি এই পেশায় নিজেকে জড়িত রেখেছেন। এই পেশা তেমন লাভজনক না। কারন আয়োজকেরা অল্প বাজেটে কোন রকম ভাবে এসব আয়োজন করে থাকে। শিল্পীরা তেমন পারিশ্রমিক পায়না।
তিনি বলেন, শুধু মাত্র শিল্পকে ভালোবাসি বলেই নিজস্ব খরচে মাঝে মাঝে এসব আসরে আসি। আমরা সারা বছর অন্য পেশায় থাকলেও এই সময়ে আমরা ছুটে আশি এক অদ্ভত নেশায়।
লোকসংস্কৃতি গবেষক মনতোষ কুমারের মতে কয়েক শ বছর আগে থেকে এই এলাকার মানুষ ধামের গান উদযাপন করে আসছে। ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রায় ছয় শতাধিক ধামের গানের আসর বসতো। তবে কালের বিবর্তনের সঙ্গে এর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
ভাওয়াইয়া যেমন বৃহত্তর রংপুর-কোচবিহারের প্রধান সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। তেমনি ধামের গানও পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ।
মনতোষ জানান, স্থানীয় উদ্যোগে অনাড়ম্বরভাবে ধামের গানের আয়োজন করা হলেও এ অঞ্চলে এই গানের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক। কয়েক দশকে ধামের গানের আসরের সংখ্যা কমে গেলেও এটি এখনও বিবর্ণ হয়ে যায়নি। বরং আধুনিকতার মিশেলে একে আরও হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যদিও আজকাল যাত্রাগানের কিছু কিছু উপাদান ধামের গানে অনুপ্রবেশ করে এর স্বকীয়তাকে নষ্ট করছে। এমনকি বাদ্যযন্ত্রেও ঢুকে পড়েছে পাশ্চাত্য উপকরণ। একে ধামের গানের বিকৃতি হিসেবেই মনে করেন তিনি।